নিরাপত্তায় উদাসীন রেলওয়ে ঘটছে নাশকতা

সিসি ক্যামেরা ‘অন্ধ’ রেখেই চলছে রেল

Passenger Voice    |    ১০:৩৭ এএম, ২০২৪-০৪-২২


সিসি ক্যামেরা ‘অন্ধ’ রেখেই চলছে রেল

নতুন নতুন রেলপথ, আনকোরা কোচ, অনলাইন টিকিট ও আইকনিক স্টেশনের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে সাড়া ফেললেও নিরাপত্তা প্রশ্নে প্রযুক্তির ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশ রেলওয়ে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে না লাগানোর ফলে রেলের নিরাপত্তায় এখনও চলছে ‘মান্ধাতা আমল’। এখনও রেলস্টেশন ও ট্রেনের কামরায় (কোচ) জনবলনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা! এ সুযোগে মাঝেমধ্যেই রেল খাতে বড় ধরনের নাশকতাকাণ্ড ঘটিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা, অনেকেই থাকছে অধরা।

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক সহিংসতার রোষানলে পড়েছিল দেশের রেল খাত। কোচের ভেতরে আগুন এবং রেলপথ উপড়ে ফেলার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। সেই সময় নাশকতা ঠেকাতে তড়িঘড়ি করে কিছু স্টেশন ও কোচের ভেতর ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসিয়েছিল রেল পুলিশ। রেলওয়ে আলাদাভাবে কিছু স্পর্শকাতর জায়গায়ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে। তবে কিছুদিন না যেতেই এসব ক্যামেরা হয়ে পড়ে অকার্যকর।

যদিও অনেক আগে থেকেই চীন ও কোরিয়া থেকে আনা বেশ কিছু কোচের ভেতর সিসি ক্যামেরা যুক্ত আছে। তবে অজানা কারণে তা সচলের ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই রেলওয়ের। এতে রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোচের ভেতরের টিকিট বাণিজ্য প্রকাশ্যে আসার ভয়ে ক্যামেরার চোখ ‘অন্ধ’ রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। এ ছাড়া দেশের অধিকাংশ রেলস্টেশনেও নেই সিসি ক্যামেরা। এতে স্টেশন ঘিরে নানামুখী অপরাধ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

রেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা কোচে যেসব ক্যামেরা যুক্ত আছে, সেগুলো কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় চালু হবে– এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য রেলের কাছে নেই। এখন সচলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কোচ বিক্রেতা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রেলের নিরাপত্তায় অনেক দেশে উন্নত নানা প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান রেলরোডস’ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার রেলপথ সুরক্ষিত রাখতে স্মার্ট সেন্সর, লেজার ও গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার (জিপিআর) ব্যবহার করা হয়। কোনো নাশকতা, প্রাকৃতিক– এমনকি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঘটলে এগুলো আগাম বার্তা দেয়। জিপিআর হলো সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক জরিপ কৌশল। রেলপথের নুড়ি, পাথরের আস্তরণের লেভেল পরিমাপ, কোথাও গর্ত বা নিচু হয়ে গেলে এবং লাইনে গঠনের কোনো পরিবর্তন বা ত্রুটি ঘটলে জিপিআর প্রযুক্তিতে জানা সম্ভব। এছাড়া চালকের গুরুতর ভুলের ক্ষেত্রে ‘পজিটিভ ট্রেন কন্ট্রোল’ (পিটিসি) প্রযুক্তিও রয়েছে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত গতির কারণে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ কিংবা লাইনচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। অন্য লাইনে ঢুকে পড়লেও এর মাধ্যমে সংকেত পাওয়া যায়।

এসব আধুনিক প্রযুক্তির কোনো কিছুই নেই বাংলাদেশে। রেলের ভেতর চালক (লোকোমাস্টার) ও অন্য সহযোগীদের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মোবাইল ফোন। কোনো অঘটন ঘটলে জনবলনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর ভর করতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মোতায়েন করা হয় আনসার সদস্য। দুর্ঘটনার আবহ চলে গেলে আবার তুলে নেওয়া হয় তাদের।

রেল কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাশকতার পর রেলের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিক বৈঠকে ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে নানা সিদ্ধান্ত হয়। জরুরি ভিত্তিতে বেশ কিছু স্টেশন ও বগিতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। তড়িঘড়ি করে রেলের ভেতরে বসানো এসব ক্যামেরা তেমন কাজে আসেনি। এছাড়া রেলের নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানেও উঠে আসে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা বগির ভেতরে সিসি ক্যামেরা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিল্টইন ক্যামেরা, ডিভিআর ও লাইন বুঝে নেওয়া হয়নি। ক্যামেরা বুঝে নেওয়ার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, যে কোনো অপরাধ নিবৃত্ত করতে সিসি ক্যামেরা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। কোড নম্বর না জানার কারণে এতদিন রেলের কামরায় সিসি ক্যামেরা চালু না হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের দেশের বাস্তবতায় যে কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সরকারি যানবাহনের ওপর গিয়ে পড়ে। নিজেদের লোকজনও কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত কিনা, তা নিশ্চিত হতে বগির ভেতরে ক্যামেরা থাকতে পারে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, ঢাকা-কক্সবাজার পথের কক্সবাজার ও পর্যটন এক্সপ্রেস, ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ পথের বনলতা এক্সপ্রেস, পদ্মা, ধূমকেতু, সুন্দরবন, চিত্রা এক্সপ্রেসের বগিতে আধুনিক সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। তবে কোনো ক্যামেরাই সচল নয়। কমলাপুর স্টেশনের পাশেই বড় দেয়ালঘেরা একটি স্থানে রেলের ‘ওয়াশপিট’। প্রতিটি রেল একবার গন্তব্যে আসা-যাওয়ার পর ধোয়ামোছা ও মেশিন সরঞ্জাম ঠিকঠাক আছে কিনা, তা দেখভালের জন্য ওয়াশপিটে তোলা হয়। শুক্রবার ওয়াশপিটে গিয়ে দেখা যায়, হাওর এক্সপ্রেসের বগি ধোয়ামোছার কাজ চলছে। ১৪ বগির মধ্যে মাত্র দুটিতে সিসি ক্যামেরা যুক্ত ছিল। সংসদ নির্বাচনের আগে এসব ক্যামেরা লাগানো হলেও এখন তা সচল নেই বলে জানান সেখানকার কর্মীরা।

ওয়াশপিটে রেলের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিনা টিকিটে রেলে ভ্রমণ করায় কিছুদিন আগে আমার এক আত্মীয়কে টিকিট কালেক্টর ধরেছিলেন। ভয় দেখিয়ে প্রথমে টিকিটের কয়েক গুণ জরিমানা আদায়ের চেষ্টা করেন। পরে অল্প ঘুষের বিনিময়ে রক্ষা পান তিনি। এটা ফোনে ওই আত্মীয় আমাকে জানান। এর পর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে উল্টো আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়।’ রেলের ওই কর্মী বলেন, ‘ভেতরে ক্যামেরা চালু হলে অনেকের উপরি রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্য দিনের পর দিন তা অচল।’

কমলাপুরে কথা হয় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের যাত্রী আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য মাঝেমধ্যে ঢাকা আসতে হয়। রেলে নাশকতার কথা মনে পড়লেই ভীতি কাজ করে। আর ট্রেনে উঠতে ইচ্ছা করে না।’

রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্বাঞ্চল) সুশীল কুমার হালদার বলেন, রেলের পূর্বাঞ্চল বিভাগে ১৭০ স্টেশনের মধ্যে ৬০টিতে সিসি ক্যামেরা আছে। বাজেটের অভাবে নতুন কোনো স্টেশনে ক্যামেরা বসানো যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে নাশকতা শুরু হলে দ্রুত কয়েকটি স্টেশনে ক্যামেরা বসানো হলেও এখনও সেই টাকা বকেয়া রয়েছে। আবার কিছু স্টেশনে ২০০৬ সাল থেকে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। দীর্ঘদিন পার হওয়ায় তা অকার্যকর। অর্থ সংকটের কারণে নতুনভাবে এসব জায়গায় উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা বসাতে পারছি না।

রেলের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিমাঞ্চল) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, পশ্চিমাঞ্চলে ৩৬ স্টেশনে সিসি ক্যামেরা আছে। অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে বসানো হবে। ঈশ্বরদীসহ দুটি স্টেশনে ৭৩টি সিসি ক্যামেরা বসাতে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, রেলের সিসি ক্যামেরাসহ সার্বিক নিরাপত্তায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। নির্বাচনের আগে জরুরি পরিস্থিতিতে পুলিশের তরফ থেকে বেশ কিছু স্টেশন ও কোচে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি এ কাজটি করবে রেলওয়ে। সিসি ক্যামেরা বসাতে তারা একটি প্রকল্প নিচ্ছে। রেলকেন্দ্রিক নিরাপত্তার জন্য এটা জরুরি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, চীন থেকে কেনা ১০০ ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা ১৩৭টি কোচে সিসি ক্যামেরা যুক্ত অবস্থায় আছে। তবে কোড এবং ভাষাগত সমস্যার কারণে এগুলো সচল করা যাচ্ছে না। দ্রুত যাতে ক্যামেরা চালু হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কেন দীর্ঘদিন এসব ক্যামেরা অকার্যকর– এ প্রশ্নে রেলের মহাপরিচালক বলেন, শুরুতে এসব ক্যামেরা নিয়ে সেভাবে কেউ মাথা ঘামায়নি। পরপর কয়েকটি নাশকতার পর বিষয়টি সামনে আসে। সরকারি টাকায় এসব কোচ কেনা হয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিটি সরঞ্জাম সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করব।

বগির ভেতরে টিকিট নিয়ে কারসাজি ও চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে ক্যামেরা সচল হচ্ছে না– এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। সিসি ক্যামেরার চোখ দ্রুত খুলে দেওয়া হবে। যেসব কোচ ও স্টেশনে সিসি ক্যামেরা নেই, সেখানে পর্যায়ক্রমে লাগাব। সারাদেশে ৪৭২ স্টেশন রয়েছে। সিসি ক্যামেরা থাকলে অপরাধীরা ভয় পায়। অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটে গেলেও দ্রুত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। কোনো জায়গা আমরা ক্যামেরার আওতাহীন রাখতে চাই না।  সূত্র: সমকাল

প্যা.ভ/ত